স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এবং এটি কিভাবে কাজ করে
বর্তমান সময়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এবং এটি কিভাবে কাজ করে। আজকের আলোচনায় সেইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। বিস্তারিত জানতে পুরো পোস্টটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
স্পেসএক্স (SpaceX) কোম্পানির স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এবং এটি কিভাবে কাজ করে এটা জানা আমাদের জরুরি কারণ বাংলাদেশে এই কোম্পানি ব্যবসা শুরু করেছে এবং এটি ব্যবহারের আগে এর সম্পর্কে জানা আমাদের জরুরি। এসব বিষয় জানতে দ্রুত মূল আলোচনায় চলে জান।
স্টারলিংক কি?
স্পেসএক্স (SpaceX) কোম্পানির একটি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট পরিশেবা হল স্টারলিংক (Starlink)।স্পেসএক্স (SpaceX) কোম্পানির সহায়ক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে Starlink Services, LLC। এটি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এবং দুর্গম এলাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ সরবরাহ করে থাকে। স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করে উপগ্রহ (স্যাটেলাইট)-এর মাধ্যমে।
আর পড়ুনঃ
পৃথিবীর চারপাশে খুব নিচু কক্ষপথে (Low Earth Orbit বা LEO) এই স্যাটেলাইটগুলো ঘোরে। এই স্যাটেলাইটগুলোর মূল উদ্দেশ্য হল পাহাড়ি এলাকা, প্রত্যন্ত গ্রাম বা সাগরের মাঝখানে ইন্টারনেট পৌঁছানো যেখানে সাধারণ তার বা মোবাইল টাওয়ার দিয়ে ইন্টারনেট পৌছাইনা।
স্টারলিংক এর আবিষ্কারক এবং এর পেছনের উদ্দেশ্য
স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এবং এটি কিভাবে কাজ করে এটা জানব তার আগে জানি এই স্যাটেলাইট স্টারলিংক এর আবিষ্কারক এবং এর পেছনের উদ্দেশ্য কি। স্টারলিংক এর আবিষ্কারক এবং এর প্রধান উদ্যোক্তা হচ্ছেন এলন মাস্ক। এটি সর্বপ্রথম চালু হয় ২০১৫ সালে আমেরিকান মহাকাশ কোম্পানি SpaceX-এর অধীনে।
স্টারলিংক এর আবিষ্কারের পেছনের উদ্দেশ্য
- প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল বা পাহাড় যেখানে ইন্টারনেট এর সেবা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ সেখানে স্টারলিংকের এর সেবা পৌছিয়ে দেওয়া যাতে করে সেখানকার মানুষ দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সেবা পেতে পারে।
- পৃথিবীজুড়ে এই উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা দিয়ে অর্জিত অর্থ SpaceX-এর বড় মিশনগুলোর (যেমন: মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানো) জন্য ব্যয় করা হবে।
- এই ইন্টারনেট সেবার মাধ্যমে ভিডিও কল, গেমিং ও অনলাইন স্ট্রিমিং আরও সময় উপযোগী করে তোলা কারণ স্টারলিংকের লো আর্থ অরবিট প্রায় ৫৫০ কিমি থাকে যার ফলে এর লেটেন্সি মাত্র ≈২৫‑৪০ মিলিসেকেন্ড কিন্তু স্থলভিত্তিক স্যাটেলাইটগুলোর ইন্টারনেট প্রায় ৩৬,০০০ কিমি উপরে অবস্থান করে যার ফলে আদেশ–প্রতিক্রিয়ায় অনেক সময় লাগে।
- অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জরুরি অবস্থায় মোবাইল টাওয়ার ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিন্তু স্টারলিংকে এই সম্ভাবনা নেই কারণ এটি স্পেস থেকে ইন্টারনেট সেবা দিবে এইজন্য ইন্টারনেট পাবেন পুরো দমে।
বাংলাদেশে স্টারলিংকের খরচ কত?
স্টারলিংকের খরচ দুই ধরণের,
১. এককালীন সেটআপ খরচঃ এক্ষেত্রে একজন নতুন গ্রাহকের স্টারলিংক কিট কিনতে খরচ পর্বে প্রায় ৪৭০০০টাকা (~ USD 390‑400)। এই কিটগুলোর মধ্যে থাকে ডিশ, রাউটার, তার এবং ইনস্টলেশন আনুষঙ্গিক জিনিস।
২. মাসিক সাবস্ক্রিপশন প্ল্যানঃ মাসিক সাবস্ক্রিপশন প্ল্যান এর মধ্যে আছে Residential Lite যার মাসিক খরচ ৪২০০ টাকা এবং থাকবে সীমাহীন ডেটা এবং ৩০০ Mbps পর্যন্ত গতি। আরেকটি Residential যার মাসিক খরচ ৬০০০ টাকা এবং সীমাহীন গতি, গতি ও লেটেন্সির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার সুবিধা।
স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে?
স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এর সম্পর্কে জানলাম এখন জানব স্টারলিংক কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে,
- এটি প্রথমত আকাশে হাজার হাজার ছোট উপগ্রহ ব্যবহার করে স্যাটেলাইট দিয়ে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার একটি প্রযুক্তি।
- এর প্রতিটি উপগ্রহ মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার উপর দিয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি ঘুরে বেড়ায় এর ফলে খুব দ্রুত ডেটা পাঠাতে পারে।
- এই উপগ্রহের সাথে সরাসরি সংযোগের জন্য আপনার বাড়িতে একটি ছোট ডিশ বা এন্টেনা বসাতে হবে।
- এই ডিশ বা এন্টেনা এই উপগ্রহ থেকে সিগন্যাল ধরে রাউটারে পাঠায় যার ফলে আপনি সেখান থেকে Wi‑Fi পান।
- এখন ধরেন আপনি ইউটিউব চালাবেন সেই অনুরোধ ডিশ থেকে সরাসরি উপগ্রহে যায়। তারপর সেখান থেকে সেই ডাটা পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনে (বড় অ্যান্টেনা ফার্ম) পাঠানো হয়।
- এরপর ইন্টারনেট থেকে উত্তর আসলে সেটা স্যাটেলাইট হয়ে ডিশে ফিরে আসে।
- এখানে উপগ্রহগুলো যেহেতু একসাথে থাকেনা সেহেতু একটা উপগ্রহ সিগন্যাল না পেলে আরেকটি উপগ্রহ সেটার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। এজন্য কখনও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশংকা থাকেনা। সবসময়ই ইন্টারনেট চালু থাকে।
- এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে খুব আরামে লাইভ ভিডিও বা গেম স্ত্রিমিং করা যায় কারণ দ্রুত ডেটা চালাচালিতে সাহায্য করে কারণ এই উপগ্রহগুলোতে রয়েছে উন্নত অ্যান্টেনা ও লেজার সিস্টেম।
- একটি উপগ্রহ আরেকটি উপগ্রহকে সরাসরি লেজারে যুক্ত হয়ে ডেটা পাঠায় মানে একদম আকাশেই ইন্টারনেট চলে।
বাংলাদেশে স্টারলিংক কবে আসবে?
স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এবং এটি কিভাবে কাজ করে এসব সম্পর্কে জানলাম এখন আমরা জানব বাংলাদেশে কবে থেকে চালু হবে। এ সম্পর্কে নিচে বর্ণনা করা হল,
- ২০২৫ সালের ২৯ মার্চ BIDA ও BTRC স্টারলিংককে অনুমোদন দেয়। এ সময় প্রেসিডেন্ট লাইসেন্স ও স্থানীয় রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়।
- এরপর ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ মার্চে যদি আদেশ পায় তাহলে জুনের মধ্যে জুনের মধ্যে চালু হওয়ার কথা ছিল।
- ২০২৫ এর ৯ এপ্রিল ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পরীক্ষামূলকভাবে এর সেবা চালু হয়। এখানে একটি লাইভ সম্মেলন হয় যেখানে এই ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয়।
- ২০২৫ সালের ২০ মে এটি সারাদেশে ঘোষণা দিয়ে চালু করা হয়।
ইউজার টার্মিনাল, ডিশ ও রাউটার কীভাবে কাজ করে
স্টারলিংক কি, এর খরচ কত এবং এটি কিভাবে কাজ করে এটা ছাড়াও আমরা জানলাম বাংলাদেশে স্টারলিংক কবে আসবে? এখন আমরা জানব ইউজার টার্মিনাল, ডিশ ও রাউটার কীভাবে কাজ করে। এ সম্পর্কে নিচে বর্ণনা করা হল,
- ইউজার টার্মিনাল বা ডিশ এর ভেতর ফেজড অ্যারে অ্যান্টেনা থাকে যেটা আবার ছোট ছোট ১,২৮০টি এন্টেনা দিয়ে তৈরি। এটাকে ইংরেজিতে বলে a honeycomb structure। ইউজার টার্মিনাল বা ডিশ বাসার ছাদে আকাশের দিকে মুখ করে বসানো থাকে এবং দায়িত্বশীলভাবে ডেটা পাঠায় আর নেয়।
- এই ডিশটি তার নিচে থাকা মোটর দিয়ে ঘুরে নিজেই উপগ্রহের জায়গা খুঁজে নেয় এবং সেদিকে ডেটা পাঠায়। এরপর আপনি ঘরে বসেই ইন্টারনেট পেয়ে যান।
একটা ছক দিতে যদি বোঝায় তাহলে যেটা দেখাবে সেটা হচ্ছে ধরেন আপনি ইউটিউব দেখবেন,
ইউটিউব দেখার রিকোয়েস্ট ------> রাউটারে যাবে -------> রাউটার সেই রিকোয়েস্ট ডিশে পাঠাবে ------> ডিশ beam দিয়ে সেটি উপগ্রহে পাঠায় ------> স্যাটেলাইট ফাইবার‑রাউটেড ইন্টারনেটে অর্থাৎ গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠায় ------> এরপর রিকোয়েস্ট ফিরে আসে–গ্রাউন্ড, উপগ্রহ, আপনার ডিশ, এবং শেষ পর্যন্ত আপনার রাউটার ও ডিভাইসে এবং আপনি ইউটিউব দেখতে পান।
স্টারলিংক সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)
স্টারলিংক কোথায় চালু আছে?
পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে স্টারলিংক চালু রয়েছে যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রেও।
স্টারলিংক এর সেটআপে কী কী থাকে?
একটি স্টারলিংক সেটআপে থাকবে ডিশ ও তার, রাউটার, পাওয়ার সাপ্লাই ও এক্সটেনশন ক্যাবল।
স্টারলিংক কিভাবে সেটআপ দিতে হয়?
এটি ছাদে যেখানে আকাশ পরিষ্কার দেখা যায় সেখানে ডিশ বসিয়ে, ক্যাবল রাউটারে সংযোগ করে তারপর শক্তি সরবরাহ করতে হয়। এটি দুই ধাপে সম্পন্ন হয়।
স্টারলিংক এ কত দ্রুত ইন্টারনেট পাওয়া যায়?
স্টারলিংক ইন্টারনেট এর গতি হবে প্রায় ৫০ থেকে ২৫০ Mbps এবং ভিডিও কল ও গেমিং এর জন্য দেরি হবে মাত্র ২০–৪০ মিলিসেকেন্ড।
স্টারলিংক এর ইন্টারনেট কত দামে পাওয়া যায়?
এককালিন স্টারলিংক এর কিট এর খরচ পরবে ৪৭০০০ টাকা এবং মাসিক ৳৪,২০০/মাস (Lite) ও ৳৬,০০০/মাস (Residential)।
স্টারলিংক ব্যবহার না করলে কি মাসিক বিল কেটে যাবে?
হ্যাঁ ব্যবহার না করলেও মাসিক সাবস্ক্রিপশন চার্জ দিতে হয় এর কারণ রিসোর্স রিজার্ভ রাখা হয়।
লেখকের মন্তব্য
সবশেষে বলা যায় স্টারলিংক হলো ভবিষ্যতের ইন্টারনেট যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে দ্রুত সংযোগ পৌঁছে দিতে সক্ষম রাখে। বিশেষ করে র্গম ও ইন্টারনেট-বঞ্চিত এলাকাগুলোর জন্য যেন এক নতুন আসার আলো। এই প্রযুক্তি বিশ্বকে আরও কাছাকাছি এনে দিয়েছে। আজকের পোস্টটি কেমন লাগলো তা কমেন্ট করে জানাবেন এবং আপনার পরিচিতজনদের সাথে শেয়ার করবেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url